বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘‘বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার সাড়ে ১৫ বছর দেশকে খুনের রাজ্যে পরিণত করেছিল। তারা (ফ্যাসিস্টরা) এর জানান দিয়েছিল ক্ষমতায় আসার দুই বছর আগে ২০০৬ সালে। ওই বছরের ২৮ অক্টোবর স্পষ্ট দিবালোকে তারা লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালিয়ে আদম সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর লাশের উপর দাঁড়িয়ে নর্তনকুর্দন করে জানিয়ে দিয়েছিল আমরা ক্ষমতায় আসলে এই খুনের রাজনীতিই করব।’’
‘‘আমরা সেদিন আমাদের বুকের কান্না বাংলাদেশের জনগণের কাছে হয়তো বা পৌঁছাতে পারিনি। এরপর বহু কায়দা করে মইন-ফখরের একটি জঘন্য সরকারের হাত ধরে পিছনের দরজায় বোঝাপড়া করে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে ২০০৮ সালে তারা জয়লাভ করে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসে সেই খুনের নেশা বাস্তবায়নের কর্মসূচি হাতে নেয়।’’
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে মৌলভীবাজার জেলা জামায়াত আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জেলা জামায়াতের আমির ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহেদ আলী। সেক্রেটারি মো. ইয়ামির আলী ও সহকারী সেক্রেটারি হারুনুর রশিদ যৌথভাবে এই সম্মেলন পরিচালনা করেন।
জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘‘ক্ষমতায় আসার দুই মাসের মাথায় প্রথমে তারা খুন করে সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক চৌকস ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে পিলখানায় (বিডিআর সদর দফতরে)। সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়। বিডিআর বাহিনী ধ্বংস করে সেই বাহিনীর সাড়ে ১৭ হাজার সদস্যকে চাকরিচ্যুত করলো। সাড়ে ৮ হাজারকে জেলে দিলো। সাড়ে ৩শ’র মতো সদস্য জেলের ভেতরেই মারা গেলেন। আমাদের গর্বের বাহিনী ধ্বংস হলো। ক্ষমতায় যাওয়ার শেষ সিঁড়ি হিসেবে এদের ব্যবহার করে চক্রান্ত করে ধ্বংস করে দিলো। বাহিনীর নাম বদলে বিজিবি রাখা হয়েছে। আগে নাম ছিল বাংলাদেশ রাইফেলস। আর এখন নাম দিয়েছে বর্ডারের চৌকিদার।
‘‘লোগো বদলিয়েছে, ড্রেস বদলিয়েছে। নাম বদলিয়ে ফেলেছে। কারা হত্যাকারী ছিল জাতিকে জানতে দেওয়া হলো না। লুকোচুরি করা হলো। রাতের অন্ধকারে বিদ্যুতের আলো কেড়ে নিয়ে, অন্ধকার করে খুনিদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো। একটা বিশেষ দেশের প্লেন কেন এসেছিল ঢাকায়? এরপর হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল কীভাবে। তার জবাব স্বৈরাচারী সরকাররা না দিলেও একদিন তাদেরকে দিতে হবে। আমরা সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’’
ডা. শফিকুর রহমান আরও বলেন, ‘‘এরপর শুরু হলো তাদের তাণ্ডব। তাদের প্রথম লক্ষ্যবস্তু করলো জামায়াতে ইসলামীকে; যারা পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক। তারা তাদের সততায় দেশবাসীকে মুগ্ধ করেছিল। দক্ষতার সাক্ষর রেখেছিলেন। দায়িত্বের পরতে পরতে সেই সমস্ত নেতৃবৃন্দকে ঠান্ডা মাথায়, মিথ্যা অভিযোগ সাজানো কোর্ট, পাতানো সাক্ষী এবং ব্রাসেলস থেকে রায় এনে সেই সমস্ত নেতৃবৃন্দকে খুন করা হলো। ফাঁসি দেওয়া হলো। কাউকে কাউকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হলো, জেলের ভেতর ইন্তেকাল করলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের মর্যাদাবান শহীদ হিসেবে কবুল করুন।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা তখন আমাদের বন্ধু সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠনকে বলেছিলাম, এটি জামায়াতের ওপর আঘাত নয়। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের এই বিশাল দেওয়াল ভেঙে দিলে বাকিরা সবাই ভেসে যাবেন, কেউ টিকতে পারবেন না। আমাদের পাশে দাঁড়ান। ফ্যাসিজমকে সম্মিলিতভাবে আমরা মোকাবিলা করি। আমরা কথাগুলো বুঝাইতে পারি নাই। সবাই মিলে একসঙ্গে সেই যুদ্ধটা করতে পারলাম না। তার পরের ইতিহাস আপনাদের সামনে পরিষ্কার। তারা আর কাউকে ছাড়লো না। এক এক করে সবাইকে ধরলো। বিএনপিকে ধরলো, হেফাজককে ধরলো, আলেম ওলামাকে ধরলো, অন্যান্য দলকে ধরলো। কাউকে তারা ছাড় দিলো না। এমনকি এইযে সাংবাদিক বন্ধুরা আজকে এসেছে নিউজ কাভার করতে; তাদেরকের ধরলো। তাদেরকে খুন করলো, তাদেরকে আমাদের সঙ্গে গুম করলো। তাদের আয়নাঘরে পাঠালো। কাউকে কাউকে ভারতের ওপাড়ে বর্ডারে নিয়ে ফেলে দিলো। এভাবে তারা সারাটা দেশকে নরকে পরিণত করেছিল।’’
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘‘চুর-ডাকাতের লিডার গালভরা বুলি দিয়েছিলেন, ‘‘যে আমি অমুকের মেয়ে আমি পালাব না’’
‘‘কিন্তু আজকে (সম্মেলনে) যুবকরা বলতেছে আমাদের ভোট চুরি করেছিল। তিনটা নির্বাচন আজ যাদের বয়স ৩০-৩২ বছর; তারা একটা ভোটও দিতে পারেনি। তাদের সমস্ত ভোটকে জেনোসাইড করেছিল, গণহত্যা করেছিল। ভোটের গণহত্যা। এদের নৈতিক সাহস ছিল না দেশে থাকার। এজন্য দেশ থেকে পালিয়ে গেছে।’’
তিনি বলেন, ‘‘জাতিকে এরা ৫৩ বছর বিভিন্ন কায়দায় ফ্যাসিজমের মাধ্যমে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি, মেজরিটি শক্তি, মাইনোরিটি শক্তি, কতভাবে যে ভাগ করেছে এরা। কারণ একটা জাতিকে যখন টুকরা টুকরা করা যায়, তখন তাদের গোলাম বানানো সম্ভব। এরা ধরে নিয়েছিল তারা দেশের মালিক, আমরা সবাই ভাড়াটিয়া। হ্যাঁ মালিকরাই দেশে আছে ভাড়াটিয়ারা পালিয়ে গেছে।’’
তিনি ভারত প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘তিনি (শেখ হাসিনা) যে দেশে আশ্রয় নিয়েছেন তারা আমাদের প্রতিবেশি। প্রতিবেশির প্রতি সম্মান রেখে বলতে চাই, আপনারা শান্তিতে থাকুন আমরা চাই। আমাদেরকে আপনারা শান্তিতে থাকতে দিন। আপনাদের পাকঘরে কী পাকাবেন আমরা জিজ্ঞেস করতে চাই না। আমাদের পাকঘরে উঁকি মেরে তাকানোর চেষ্টা করবেন না। আমাদেরকে আপনারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেন ভালো; কিন্তু নিজের চেহারা একবার আয়নাতে ভালোভাবে দেখুন। আপনারা সেখানে যাদেরকে মাইনরিটি বলেন তাদের সাথে আপনারি কি আচরণ করেন। আমাদেরকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সবক দিতে হবে না। যুগযুগ ধরে এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এদেশের মানুষ প্রমাণ দিয়েছে।’’
তিনি নেতাকর্মীদের চারটি বিষয় তুলে ধরেন। এর মধ্যে জ্ঞানের রাজ্যে এগিয়ে গিয়ে সাহসী হয়ে কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান করেন। সব শেষ তিনি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন, কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, জামাতের পল্টন থানা আমীর শাহীন আহমদ খান, সিলেট মহানগর জামায়াতের আমীর মো. ফখরুল ইসলাম ও সিলেট জেলা আমীর মাওলানা হাবিুবুর রহমান প্রমুখ।
অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন, হবিগঞ্জ জেলা আমীর ও কেন্দ্রীয় মজলিশে সুরার সদস্য কাজী মাওলানা মুখলিছুর রহমান, মৌলভীবাজার জেলার সাবেক আমীর ও কেন্দ্রীয় মজলিশে সুরার সদস্য দেওয়ান সিরাজুল ইসলাম মতলিব ও মো. আবদুল মান্নান, মৌলভীবাজার জেলার নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুর রহমান, জেলা শূরা ও কর্মপরিষদ সদস্য এবং মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী মাওলানা আমিনুল ইসলাম, ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগর সভাপতি শরিফ মাহমুদ, কুলাউড়া উপজেলা জামায়াতের আমীর আব্দুল মুনতাজিম, রাজনগর উপজেলা জামায়াতের আমীর আবু রাইয়্যান শাহিন, মৌলভীবাজার পৌর জামায়াতের আমীর তাজুল ইসলাম, মৌলভীবাজার শিবিরের জেলা সভাপতি হাফিজ আলম হোসাইন, মৌলভীবাজার পৌর শিবিরের সভাপতি তারেক আজিজ প্রমুখ।
এছাড়া সম্মেলনে বক্তব্য বন্ধুপ্রতিম সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির আহবায়ক মো. ফয়জুল করিম ময়ূন, মৌলভীবাজার খেলাফত মজলিসের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আব্দুস সবুর।